প্রতি বছরই রাজশাহীতে কমছে ধানের আবাদ। কৃষকরা ঝুঁকছে ফল চাষের দিকে। ধানের বদলে আম ও পেয়ারা চাষে ধানের জমি কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চালের চাহিদা বাড়লেও রাজশাহীতে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে ২৩৪ হেক্টর করে ধানের জমি। এ জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩শ’৬৩ হেক্টর। ২০১৬-১৭ তে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯শ’ ৯৯ হেক্টর। ২০১৭-১৮ তে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭শ’৫৮ হেক্টরে। আর ২০১৬-১৭ তে ধানের আবাদ হয়েছিল ৭৫ হাজার ৩শ’ হেক্টর যা ২০১৭-১৮তে কমে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৩শ’১৪ হেক্টরে।
আবাদযোগ্য জমির ১০ ভাগ দখল করে নিয়েছে আম চাষিরা। রাজশাহীর ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩শ’৬৩ হেক্টর জমির ৫ হাজার ৬০ হেক্টর জমিই দখল করে নিয়েছে পেয়ারা চাষিরা। এর ফলে ধানের প্রতি মৌসুমে রাজশাহীতে ধানের আবাদ কমছে ১৬ হেক্টর করে। এ তথ্য রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। আর বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা,আম ও পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলের আবাদ বৃদ্ধিতেও কমে যাচ্ছে ধানের আবাদ। তাই জাতীয় স্বার্থে ধানের আবাদ অক্ষুন্ন রাখা নয়, উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ধানের আবাদ হয় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে। আর রাজশাহী ধান গবেষণার চিফ সাইন্টিফিক অফিসার ড: রফিকুল ইসলামের মতে দেশে ধানের আবাদ হচ্ছে ১১.৪২ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে। নিত্য নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করে কৃষিবিদগণ বাংলাদেশের মানুষের আহার যুগিয়ে আসছেন। তাদের অবদানে দেশ খাদ্যে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে।
ইতোমধ্যে কৃষি বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে উন্নত ফলনশীল ৮৬ জাতের ধানের বীজ অবমুক্ত করেছেন। একই কথা জানিয়েছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (শস্য) আব্দুল আওয়াল।
যে হারে ধানের আবাদ কমছে তাতে ধান উৎপাদন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। অভিজ্ঞজনদের ধারণা এ ভাবে ধানের আবাদ কমে যাওয়া আতঙ্কের বিষয়। তাই জাতীয় স্বার্থে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ধানের আবাদি জমিকে রক্ষা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উদ্যান) মঞ্জুরুল হক জানান, কৃষকরা লাভের আশায় ফলের আবাদের দিকে ঝুঁকছে। শুধু সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করলে চলবে না। জাতীয় স্বার্থের কথাও চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও খাদ্য শস্য হিসেবে ধানের আবাদ স্বাভাবিক রাখতে হবে। দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
দেশের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ধান। শুধু বাংলাদেশ নয় এশিয়ার ৮৭ ভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। আর বিশ্বে ৫০ ভাগ মানুষই ভাতের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে ধান উৎপাদন হয় তার অর্ধেক ধানই হয় এই উপমহাদেশের দুই দেশ- চীন ও ভারতে। গুণাগুণের দিক থেকে ফলের চাইতে চালকে যতই খাটো করে দেখা হোক না কেন চালের পুষ্টি শক্তিগুণও কম নয়। গুণাগুণের দিক থেকে ১শ’ গ্রাম চালে ৩৪০ থেকে ৩৫০ কিলো ক্যালোরী শক্তি পাওয়া যায়। তথ্য কৃষি বিশেষজ্ঞদের। আর এশিয়ার মানুষের প্রধান খাদ্য যেখানে ধান সেখানে ধানের আবাদ কমে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না।
ভারতের কৃষি বিশেষজ্ঞ বিজন অধিকারী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে ধানের উৎপাদন শুরু হয়। এখনও বিশ্বে ১১৫ টি দেশে ধান উৎপাদন হয়। এর ২৫ ভাগ ধানই হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। আর পৃথিবীতে যা ধান উৎপাদন হয় তার অর্ধেকই হয় বাংলাদেশ,ভারত ও চীনে। এক সময় আমাদের দেশে ৮২ জাতের ধান উৎপাদন হতো। বর্তমানে সেচ নির্ভর ও রাসায়নিক সার নির্ভর চাষের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে প্রাচীনকালের সকল জাতের ধানই হারিয়ে গেছে।
রাজশাহীতে ২০১৫-১৬ মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬৯ হাজার ৪শ’ ১১ হেক্টর থাকলেও ক্ষতিসহ আবাদ হয়েছে ৬৭ হাজার ৪শ’৯০ হেক্টর। ২০১৬-১৭ তে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬৯ হাজার ৪শ’১২ হেক্টর ধরা হলেও আবাদ হয়েছে ৬৭ হাজার ৩শ’৩০ হেক্টর। আর ২০১৫-১৬তে আউস ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ হাজার ৬শ’১২ হেক্টর ধরা হলেও আবাদ হয়েছিল ৪০ হাজার ২শ’৬৯ হেক্টর। ২০১৬-১৭ তে আউস ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪৬ হাজার ২শ’ ০৯ হেক্টর ধরা হলেও ক্ষতিসহ আবাদ হয়েছিল ৪৭ হাজার ৯শ’ ২৯ হেক্টর। আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৫ হাজার ২শ’ ২৪ হেক্টর. সেখানে আবাদ হয়েছে ৭০ হাজার ৩শ’৩০ হেক্টর। এতে আউসের আবাদ স্বাভাবিক থাকলেও কমেছে বোরো ও আমন ধানের আবাদ।
ইতোমধ্যে চাউলের বাজার নিয়ে বাংলাদেশ উত্তপ্ত। এর পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও কাজ করেছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সুযোগে চাল ব্যবসায়ীদের কারসাজি। এমন অবস্থা এড়ানো সহজ নয়। আমাদের সব সময় এধরনের সঙ্কট বা দুর্যোগ মোকাবিলা করেই চলতে হবে। আর বাংলাদেশ ধানের আবাদ অক্ষুন্ন রেখে যদি খাদ্যের মজুদ বাড়াতে না পারে তা হলে দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
ঘটনা যাই ঘটুক না কেন বাংলাদেশের মত একটা খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে ধানের আবাদ কমে যাবে এটা মেনে নেয়া যায় না। চালের মূল্য বৃদ্ধিতে যখন পরিবেশ উত্তপ্ত ঠিক তখনই ধানের আবাদ কমে যাবার খবরে ধানের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক।
ধানকে পিছনে ফেলে রাজশাহীতে বেড়ে চলেছে ফলমূলের আবাদ। বেশির ভাগ জমিতে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ফলমূল। মোট কৃষি জমির ১০ ভাগ জমিই দখল করে নিয়েছে আম চাষিরা। শুধু গোদাগাড়ী উপজেলার ৩৯ হাজার ৭শ’ ৯০ হেক্টর কৃষি জমির ৩ হাজার ৬শ’৯০ হেক্টর জমিই দখল করেছে পেয়ারা চাষিরা। সেখানে মাঠকে মাঠ পেয়ারা চাষ হতে শুরু করেছে। এতে কৃষক লাভবান হলেও কমছে ধানের আবাদ। এতে জাতীয় স্বার্থ চরম ভাবে বিপন্ন হতে পারে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ( শস্য) আব্দুল আওয়াল বলেন, কৃষক ফল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন তাই তারা ফলের আবাদের দিকে ঝুঁকছেন।
উপপরিচালক ( উদ্যান) মঞ্জরুল হক বলেন, কৃষক শস্য উৎপাদন করে দেশকে খাদ্য ভান্ডারে পরিণত করেছে। আবার ফল উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় রাজশাহী ফল ভান্ডারে পরিণত হতে চলেছে। তবে এতো কিছুর পরও কথায় আছে না, মাছে -ভাতে বাঙ্গালী। এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। আর বিশ্বে খাদ্য শস্যের তালিকার এক নম্বরেই আছে ধান। আর মনে রাখতে হবে বাঙালির প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না, বাঙালিও ভাত ছাড়া বাঁচবে না। বাঙালিদের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাতের কোন বিকল্প নাই। তাই দেশ যতই ফলে ফলে ভরে উঠুক ভাতের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা থাকবেই। কিন্তু যে ভাবে ধানের আবাদ কমছে তাতে ভবিষ্যতে যেন আমাদের কোন খাদ্য সঙ্কটে না পড়তে হয় সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে।